ঈদুল আজহার একদিন পূর্বে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয় রাজধানীর হাজারীবাগের জমি ব্যবসায়ী মো. এখলাস কে ।
হাট থেকে কোরবানির পশু ক্রয় করে বাড়ীতে রেখে চা খেতে দোকানে গিয়ে আর বাসায় ফিরেনি সে, দুই দিন পর পাওয়া গেল বস্তাবন্দি বিকৃত মরদেহ।
তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা জানান চাঞ্চল্যকর এই হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মনির হোসেন ওরফে ট্যানারি মনির । একাধিক ট্যানারির মালিক হওয়ায় হাজারীবাগে তিনি ‘ট্যানারি মনির’ নামেও পরিচিত। পুরান ঢাকায় তাঁর রয়েছে বেশ কয়েকটি বাড়ি।
এখলাস হত্যা মামলায় মনির সহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলেন মনিরের ব্যক্তিগত সহকারী ঝন্টু মোল্লা, মো. এসহাক, আবদুর রহমান ওরফে কাল্লু ও মো. ফয়সাল।
পুলিশ সুত্রে জানা যায় মনিরের জীবন রূপকথার মতো। ট্যানারি শ্রমিক থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক তিনি। বারবার খুন করেও প্রভাবশালীদের তদবিরে ছাড়া পেয়েছেন। ২০০২ সালে রাজধানীর একটি পেট্রোল পাম্পের সামনে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় রুহুল আমিন রুহুল নামের একজনকে। ওই মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন মনির। এ ছাড়া ২০১৫ সালে জসিম নামে হাজারীবাগে একজনকে খুন করা হয়েছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীদের ব্যবহার করে ওই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি।
টাকার জোর এবং প্রভাবশালীদের তদবিরে বারবার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন মনির। ফলে দিন দিনই আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাঁর সর্বশেষ টার্গেট ছিল এখলাস। পরিকল্পিতভাবে ২০ লাখ টাকায় খুনিদের ভাড়া করে তাঁকে হত্যা করা হয়। জমি ও এখলাসের সাবেক স্ত্রীকে নিয়ে দ্বন্দ্বে তাকে খুন করান মনির। এখলাসের সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল মনিরের। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। সেটাই এ হত্যাকাণ্ডের কারণ বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তারা।
ঈদুল আজহার পরদিন কামরাঙ্গীরচরের কোম্পানিঘাটের পশ্চিম ঘাট এলাকায় প্লাস্টিকের বস্তার ভেতর থেকে এখলাসের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর মাথার ডান পাশে, মুখ, নাকসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গভীর আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ ঘটনার প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে মনিরকে গ্রেপ্তারের পর বেড়িয়ে আসছে তাঁর অতীতের ভয়ংকর অজানা তথ্য ।
জানা যায়, হাজারীবাগ ও সাভার এলাকায় একাধিক ট্যানারি কারখানার মালিক মনির জমি কেনাবেচার ব্যবসাও করতেন। সেই সুবাদে তিনি এখলাসের সাথে জমি ক্রয়-বিক্রয় করতেন।
কামরাঙ্গীরচর থানায় এখলাস ও তাঁর পরিবারের প্রায় ৪০ শতাংশ জমি সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করে। অধিগ্রহণের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে জাল কাগজপত্র তৈরি করেছিলেন মনির। এখলাস জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি আবেদন করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, জমির মালিকানা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যেন অধিগ্রহণের অর্থ অন্য কাউকে দেওয়া না হয়। এই জমির জন্য জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ বাবদ যে ৯০ কোটি টাকা পাবেন, এর মধ্যে ৩৫ কোটি টাকা পাবেন মনির। তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে মনির চেয়েছিলেন, পুরো জমির টাকা একাই পকেটে পুরাবেন। এখলাস এটা মেনে না নিয়ে বাধা দেন।
তখন জেলা প্রশাসন টাকা দেওয়া বন্ধ করেন। ফলে মনির তার ভাগের ৩৫ কোটি টাকাও পাচ্ছিলেন না। এ নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে মনির তাঁর সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে।
তথ্য মতে জানা যায়, মনির এখলাসের দ্বিতীয় স্ত্রী বীথি আক্তারের সঙ্গে কৌশলে গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন । সম্পর্কের জানা- জানি হলে একপর্যায়ে এখলাসকে ডিভোর্স দেন বীথি।
এ ঘটনায় মনিরকে হুমকি দিয়ে এখলাস বলেছিলেন, ‘তুই আমার জমিজমা দখল করার চেষ্টা করছিস। স্ত্রীকেও কবজায় নিয়েছিস। তোকে দেখে নেব।’ এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মনির গোপনে এখলাসকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এখলাস এক নারীকে বিয়ে করেন মনিরের মধ্যস্ততায় পরে জানতে পারেন, ওই নারীর সঙ্গে মনিরের সম্পর্ক রয়েছে। এ ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। টাকা ও নারীর বিষয়টির জের ধরে মনির ঝন্টু মোল্লাকে দিয়ে এখলাসকে খুন করান। এখলাসকে খুন করার জন্য ২০ লাখ টাকায় চুক্তি করেন মনির। কয়েক মাস আগে মনির ওমরাহ করতে যাওয়ার আগে ‘কাজ’ সমাধা করতে ভাড়াটে খুনিদের নির্দেশ দিয়ে যান। তবে তারা এখলাসকে খুন করতে ব্যর্থ হলে ঈদের আগে নিজের ব্যক্তিগত সহকারী ঝন্টু মোল্লাকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে এখলাসকে হত্যার নির্দেশ দেন। ঝন্টু ১১ লাখ টাকায় কিলার ফয়সাল আর কাল্লুকে ভাড়া করেন। হত্যার সমন্বয় করে এসহাক। এসহাক তাদের নির্দেশ দেয়, ‘টাকা যত লাগে নিবি, লাশ বিকৃত করা চাই।’
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে মতে পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ বলেন, মনিরের ব্যক্তিগত সহকারী ঝন্টু মোল্লা এখলাসকে খুন করার জন্য আবদুর রহমানকে ভাড়া করেন। পরে রহমান ও ফয়সাল কৌশলে এখলাসকে কামরাঙ্গীরচরের স্থানীয় একটি টেইলার্সে ডেকে নেন। সেখানে শ্বাসরোধে এখলাসকে খুন করে মরদেহ বস্তায় ভরে ফেলে দেয় খুনিরা।
হাজারীবাগের স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ জানায়, এখলাস খুনের প্রধান আসামি মনির নোয়াখালীর একসময়ের দিনমজুর আবদুর রহিমের ছেলে। আবদুর রহিম হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানায়ও কাজ করতেন। হাজারীবাগে বাবার সঙ্গে ট্যানারি কারখানায় অবস্থান করতেন মনির। তখন চামড়ার গায়ের ময়লা পরিষ্কারের কাজ নেন।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ওই এলাকার সংসদ সদস্য প্রয়াত নাসিরউদ্দীন পিন্টুর পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর উত্থান শুরু হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের সহযোগিতায় নিজে চামড়ার কেনাবেচা শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি ভূমিও দখল করেন। এভাবে শূন্য থেকে চার-পাঁচটি ট্যানারি ও শত শত কোটি টাকার মালিক হন তিনি।
ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, বীথির সঙ্গে এখলাসের বিয়ে মনিরই দিয়েছিলেন। বিয়ের পর এখলাস জানতে পারেন, মনিরের সঙ্গে বীথির সম্পর্ক আগে থেকেই ছিল, যা বিয়ের পরও বহাল আছে। এ নিয়েও মনিরের সঙ্গে এখলাসের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। জমিজমার অর্থ আর বীথিকে কেন্দ্র করেই হত্যার পরিকল্পনা করেন মনির। মনির প্রায় ৪-৫ শত কোটি টাকার মালিক। এর আগেও দুটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার পরও তাঁর সাজা হয়নি।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার থাইল্যান্ড থেকে ঢাকায় ফেরার পর বিমানবন্দর এলাকা থেকে অভিযুক্ত ঝন্টু মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে ডিবির লালবাগ বিভাগ। তিনি চার দিনের পুলিশ রিমান্ডে ছিলেন। তাঁর দেওয়া তথ্যে এলিফ্যান্ট রোড ও কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে কাল্লু ও সমন্বয়কারী এসহাককে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় মাগুরা ও যশোরের বেনাপোল বন্দর এলাকায় অভিযান চালিয়ে মনির ও ফয়সালকে গ্রেপ্তার করে ডিবির অপর দুটি দল। গ্রেপ্তারের সময় মনিরের কাছে দুটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট, একটি মোবাইল ফোন, ২২ হাজার টাকা ও পাঁচ হাজার রুপি জব্দ করা হয়।
হত্যা মামলার বাদী নিহতের ভাই মোহাম্মদ জুয়েল বলেন, শুরু থেকেই আমরা বলছিলাম, এ হত্যার পেছনে কোনো রাঘববোয়াল জড়িত। মনিরকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। নিহতের মা বলেন, আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে।কারণ আপনজন হারানোর বেদনা কতখানি তাঁর চাইতে বেশি কেউ বুঝে না। এখলাসের ছেলে বলেন আমি শিশু বয়সে এতিম হয়েছি। আমার বাবার হত্যাকারীর দ্রুত ফাঁসি চাই।